আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
মাছ চাষ বাণিজ্যিকভাবে একটি সহজ কৃষি উদ্যোগ হতে পারে । কিন্তু এটি উচ্চ মানের প্রজনন, সরবরাহ চেইন পরিচালনা, এবং বাজারের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে। আবার কোনো নির্দিষ্ট জলাশয়ে/জলসীমায় পরিকল্পিত উপায়ে স্বল্প পুঁজি, অল্প সময় ও উন্নতি প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছের উৎপাদনকে বিদ্ধি কে আধুনিক মাছ চাষ বলে। বিভিন্ন নিয়ম মেনে প্রাকৃতিক উৎপাদনের চেয়ে অধিক মাছ উৎপাদনই মাছ চাষ।
পোস্ট সূচিপত্রঃ আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ সম্পর্কে জেনে নিন
ভূমিকাঃ
মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ, যা কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন
এবং পুষ্টি সরবরাহে মৎস্য সম্পদের বিশেষ ভূমিকা আছে। বাংলাদেশে, মাছ চাষ একটি
মৌলিক উদ্যোগ হয়ে উঠেছে এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সম্প্রসারণে সাহায্য
করছে। মাছ চাষের সাথে সাথে প্রকৃতি বজায় যাচ্ছে এবং এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই লেখায়, আমরা মাছ চাষের বাণিজ্যিক সফলতার উপর
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি পর্যালোচনা করব।
মাছের গুণাগুণ ও উপকারিতা
আমাদের দেশের স্বাদু পানিতে ২৬০টিরও বেশি প্রজাতির মাছ রয়েছে। এছাড়া খাড়ি অঞ্চলে
ও লোনা পানিতে কয়েক শত প্রজাতির মাছ আছে। তবে চাষযোগ্য মাছগুলো হলো- রুই, কাতলা,
মৃগেল, কালিবাউস, সিলভারকার্প, মিররকার্প, গ্রাসকার্প, কমনকার্প, বিগহেড,
রাজপুঁটি, নাইলোটিকা, বিদেশি মাগুর, থাই পাঙ্গাশ প্রভৃতি। এসব মাছের কিছু গুণাগুণ
আছে-
এসব মাছ খুব দ্রুত বাড়ে এবং খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা
করে না । পুকুরে বেশি সংখ্যায় চাষ করা যায়। পানির সব স্তর থেকে খাবার গ্রহণ করে,
তাই পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে; এসব মাছ খেতে খুব সুস্বাদু বাজারে এসব মাছের
প্রচুর চাহিদা আছে সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।
বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের জন্য পুকুরকে প্রস্তুত করে নেয়াই ভালো। কারণ একটি পুকুর
মাছ চাষের উপযুক্ত না হলে এবং পুকুর প্রস্তুত না করে চাষ শুরু করে দিলে বিনিয়োগ
ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ঝুঁকি এড়াতে এবং লভ্যাংশ নিশ্চিত করতেই বৈজ্ঞানিক কৌশল
অনুসরণ করে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে।
মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতি
- পুকুরের পাড় ও তলা মেরামত করা
- পাড়ের ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার করা
- জলজ আগাছা পরিষ্কার করা
- রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা; ১. পুকুর শুকানো ২. বার বার জাল টানা ৩. ওষুধ প্রয়োগ- রোটেনন। পরিমাণ ২৫-৩০ গ্রাম/শতাংশ/ফুট। এর বিষক্রিয়ার মেয়াদ ৭-১০ দিন। প্রয়োগের সময় রোদ্রজ্জ্বল দিনে। ২. ফসটক্সিন/ কুইফস/সেলফস ৩ গ্রাম/শতাংশ/ ফুট। মেয়াদ এবং সময় পূর্বের মতো।
- চুন প্রয়োগ: কারণ/কাজ/উপকারিতা সাধারণত ১ কেজি চুন/শতাংশ প্রয়োগ করতে যদি ঢ়ঐ এর মান ৭ এর আশেপাশে থাকে। বছরে সাধারণত ২ বার চুন প্রয়োগ করতে হয়। একবার পুকুর তৈরির সময়, দ্বিতীয় বার শীতের শুরুতে অগ্রহায়ণ মাসে।
চুন প্রয়োগের উপকারিতা ও সাবধানতা
পানি পরিষ্কার করা/ঘোলাটে ভাব দূর করা এবং pH নিয়ন্ত্রণ করে। রোগ জীবাণু ধ্বংস
করে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।বিষাক্ত গ্যাস দূর করে শ্যাওলা নিয়ন্ত্রণ
করে। চুন কখনও প্লাস্টিকের কিছুতে গোলানো যাবে না। পুকুরে মাছ থাকা অবস্থায় চুন
গোলানোর ২ দিন পর পুকুরে দিতে হয়।গোলানোর সময় এবং দেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন
নাকে মুখে ঢুকে না যায়।
সার প্রয়োগ প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং জৈব সার/প্রাকৃতিক
যা কিনা প্রাণীকণা তৈরি করে। গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, কম্পোস্ট; অজৈব বা
রাসায়নিক বা কৃত্রিম সার ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি যা উদ্ভিদ কণা তৈরি করে।
নতুন পুকুরে সার প্রয়োগ এর মাত্রা
- প্রতি শতাংশে গোবর ৫-৭ কেজি
- হাঁস মুরগির বিষ্ঠা ৫-৬ কেজি
- কম্পোস্ট ১০-১২ কেজি এবং ইউরিয়া ১০০-১৫০ গ্রাম টিএসপি ৫০-৭৫ গ্রাম।
পুকুর প্রস্তুতির আনুমানিক সময়
পাড় ও তলা+ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার = ২ দিন; ক্স রাক্ষুসে মাছ পরিষ্কার = ৩ দিন (৭-১০
দিন পর্যন্ত বিষক্রিয়া থাকে)। চুন প্রয়োগ = ৩-৫ দিন; * সার প্রয়োগ = ৭ দিন; এরপর
পোনা ছাড়া হবে। গড়ে মোট ১৭ দিন (২+৩+৫+৭)।পুকুরে চাষযোগ্য মাছের বৈশিষ্ট্য-
দ্রুতবর্ধনশীল; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি; বাজার চাহিদা বেশি।
পুকুর নির্বাচন
পুকুরটি খোলামেলা জায়গায় এবং বাড়ির আশপাশে হতে হবে।মাটির গুণাগুণ পুকুরের জন্য
খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি পুকুরের জন্য
ভালো।পুকুরের আয়তন কমপক্ষে ১০ শতাংশ হতে হবে। ৩০ শতাংশ থেকে ১ একর আকারের পুকুর
মাছ চাষের জন্য বেশি পুকুর পাড়ে বড় গাছ বা ঝোপ-ঝাড় থাকা যাবে না।
পুকুর প্রস্তুত
পোনা মাছ ছাড়ার আগে পুকুর তৈরি করে নিতে হবে। সাধারণত পুরনো পুকুরই তৈরি করে নেয়া
হয়। পুকুর প্রস্তুতির কাজটি পর্যায়ক্রমে করতে হবে।
- ১ম ধাপ : জলজ আগাছা-কচুরিপানা, কলমিলতা, হেলেঞ্চা শেকড়সহ তুলে ফেলতে হবে;
- ২য় ধাপ : শোল, গজার, বোয়াল, টাকি রাক্ষুসে মাছ এবং অবাঞ্ছিত মাছ মলা, ঢেলা, চান্দা, পুঁটি সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলতে হবে।
- ৩য় ধাপ : এরপর প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরে পানি থাকলে ড্রামে বা বালতিতে গুলে ঠা-া করে পুরো পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
- ৪র্থ ধাপ : মাটি ও পানির গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে চুন দেয়ার এক সপ্তাহ পর জৈবসার দিতে হবে।
- ৫ম ধাপ : পুকুর শুকনা হলে পুকুরে সার, চুন, গোবর সব ছিটিয়ে দিয়ে লাঙল দিয়ে চাষ করে পানি ঢুকাতে হবে।
- ৬ষ্ঠ ধাপ : পোনা মজুদের আগে পুকুরে ক্ষতিকর পোকামাকড় থাকলে তা মেরে ফেলতে হবে;
- ৭ম ধাপ : পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে পোনা মজুদ করতে হবে। মৃত্যুর হার যেন কম থাকে সেজন্য পোনার আকার ৮-১২ সেন্টিমিটার হতে হবে।
- ৮ম ধাপ : পোনা হাড়িতে বা পলিথিন ব্যাগে আনা হলে, পলিথিন ব্যাগটির মুখ খোলার আগে পুকুরের পানিতে ২০-৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে; তারপর ব্যাগের মুখ খুলে অল্প করে ব্যাগের পানি পুকুরে এবং পুকুরের পানি ব্যাগে ভরতে হবে।
- ৯ম ধাপ : দিনে দুইবার অর্থাৎ সকাল ১০টায় এবং বিকাল ৩টায় খৈল, কুঁড়া, ভুসি ইত্যাদি সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
সতর্কতা :
- রোগ প্রতিরোধী মাছের চাষ করতে হবে।
- সঠিক সংখ্যায় পোনা মজুদ করতে হবে।
- পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং পুকুরে যাতে আগাছা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- প্রতি ৩-৪ বছর পরপর পুকুর শুকিয়ে ফেলতে হবে।
বাণিজ্যিকভাবে চাষযোগ্য মাছ
দেশি কার্প- রুই, কাতলা, মৃগেল, কালি বাউশ; বিদেশি কার্প- গ্রাস কার্প, সিল্ভার
কার্প, কার্পিও, মিরর কার্প, বিগহেড কার্প ছাড়াও পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া,
সরপুঁটি/রাজপুঁটি, কৈ, চিংড়ি এসব।
বিভিন্ন স্তরের মাছ একসাথে চাষের আনুপাতিক হার।
উপরের স্তর ৪০%; মধ্য স্তর ২৫%; নিম্ন স্তর ২৫%; সর্বস্তর ১০% মোট ১০০%। সাধারণত
শতাংশ প্রতি ১৫০টি পোনা ছাড়া যায়। এ হিসাবে ৩০ শতাংশের একটি পুকুরে মোট ৪৫০০টি
পোনা ছাড়া যাবে। এবং উপরের স্তরের মাছ থাকবে {(৪০ঢ৪৫০০)/১০০}=১৮০০টি পোনা
পুকুরে মাছ চাষ
- সনাতন পদ্ধতির মাছ চাষ : এ পদ্ধতিতে পুকুরের কোনো ব্যবস্থাপনা ছাড়াই মাটি ও পানির উর্বরতায় পানিতে যে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় মাছ তাই খেয়ে জীবন ধারণ করে। এক্ষেত্রে আলাদা কোনো পরিচর্যা নিতে হয় না।
- আধা-নিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ : এ পদ্ধতিতে নিয়মমতো পুকুর প্রস্তুত করে আংশিক সার ও খাদ্য সরবরাহ করে মাছের খাদ্য উৎপন্ন করতে হয়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপাদিত খাদ্যের সঠিক
- নিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ : অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের জন্য সার ব্যবহার করে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হয়।
- কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ : পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপন্ন খাবার সম্পূর্ণ ব্যবহার করার জন্য রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, বিগহেড, সিলভারকার্প, কমনকার্পসহ প্রজাতির মাছ একত্রে চাষ করা যায়।
মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিচর্যা
- মাছ প্রক্রিয়াজাতের সময় হাত দিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না; মাছ ধরার পর মাছের আকৃতি অনুযায়ী আলাদা করে ফেলতে হবে; বাক্সে বা পাত্রে বরফ দিয়ে স্তরে স্তরে মাছ সাজাতে হবে।
- বর্ষার শেষে পুকুরের পানিতে লাল বা সবুজ সর পরলে তা তুলে ফেলতে হবে; পানির সবুজভাব কমে গেলে অবশ্যই পরিমাণমতো সার দিতে হবে; মাঝে মাঝে জাল টেনে মাছের অবস্থা দেখতে হবে; পুকুরে জাল টেনে মাছের ব্যায়াম করাতে হবে।
আমাদের শেষ কথা
মাছ চাষ বাণিজ্যিকভাবে একটি সহজ কৃষি উদ্যোগ হতে পারে, কিন্তু এটি উচ্চ মানের
প্রজনন, সরবরাহ চেইন পরিচালনা, এবং বাজারের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী পরিচালিত হতে
হবে। এই উপযোগী তথ্য এবং সুঝাব মাছ চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু করার জন্য সাহায্যকারী
হতে পারে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url